জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধিগুলো মেনে চলায় জনগণের অনীহা, মাস্ক না পরা এবং ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ‘আয়েশি দৃষ্টিভঙ্গি’র কারণেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করেছে।
তারা বলেছেন যে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি একটি সতর্কবার্তা। কেননা আগামীতে তাপমাত্রা আরও কমে যাবে এবং করোনার বিস্তার ও মৃত্যুর হারও বেড়ে যাবে।
বর্তমান পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, মে ও জুন মাসে করোনার প্রাদুর্ভাবের চূড়ান্ত সময়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০০০ মানুষ করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয় এবং গড়ে প্রায় ৫০ জন মারা যান। ওই সময়ে পজেটিভের হার ছিল ২৪-২৫ শতাংশ।
তবে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে সংক্রমণের হার কিছুটা কমতে শুরু করে। এক পর্যায়ে, সংক্রমণের হার অক্টোবরে ১০ শতাংশে নেমে এসেছিল, তবে এখন এটি আবার বাড়তে শুরু করেছে।
গত ৩১ অক্টোবর, দেশে ১৩২০ জন নতুন করে করোনায় সংক্রমিত হন। শনাক্তের হার ছিল ১১.৪৫ শতাংশ। ১ নভেম্বর ১৫৬৮ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়, হার ছিল ১২.৫০ শতাংশ, যেখানে ২ নভেম্বর ১৭৩৬ জন শনাক্ত হন, হার ছিল ১৩.৪৭,
৩ নভেম্বর ১৬৫৯ জন শনাক্ত হন, হার ছিল ১১.৮০ শতাংশ। ৪ নভেম্বর ১০.৯০ শতাংশ হার নিয়ে শনাক্ত হন ১৫১৭ জন। ৫ নভেম্বর ১২.১০ শতাংশ হার নিয়ে শনাক্ত হন ১৮৯১ জন, ৬ নভেম্বর ১০.৮৬ হার নিয়ে শনাক্ত হন ১৪৬৯ জন এবং ৭ নভেম্বর ১১.২৯ শনাক্তের হার নিয়ে শনাক্ত হন ১২৮৯ জন।
তাপমাত্রা হ্রাস
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেছেন, অক্টোবরের শেষে বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তর-পশ্চিম দিকের বাতাসের ফলে গত সপ্তাহে দেশের তাপমাত্রা হ্রাস পেয়েছে।
তিনি জানান, শুক্রবার পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, পাবনা ও রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে ১৪-১৫ ডিগ্রি ন্যূনতম তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা শ্রীমঙ্গলে ১১.৫ এবং ঢাকায় ১৮ ডিগ্রি ছিল।
‘যখন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রির নীচে নেমে আসে, আমরা এটিকে ঠান্ডা আবহাওয়া বলি। সুতরাং, আপনি বলতে পারেন শীত ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, তবে তাপমাত্রা কয়েকদিনের মধ্যে বাড়বে এবং এই মাসের শেষ সপ্তাহে এটি আবার কমতে পারে,’ বজলুর বলেন।
তিনি বলেন, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শীত পুরোদমে শুরু হতে পারে এবং বেশ কয়েকটি শৈত প্রবাহ এ সময় দেশে আঘাত হানতে পারে। সাধারণত, জানুয়ারি বাংলাদেশের শীতলতম মাস এবং ঠান্ডা আবহাওয়া ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত চলতে পারে।
করোনা বৃদ্ধির পেছনে কারণ
ইউএনবির সাথে আলাপকালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক বলেন, করোনাভাইরাস আবারও বাড়ার পেছনে কারণ প্রধানত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদাসীনতা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে ও মাস্ক পরতে লোকদের উদাসীনতা।
তিনি মনে করেন, ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে তাপমাত্রা হ্রাসই প্রধান কারণ নয়। ‘যদি কোনো কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকে তবে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং আমাদের দেশে এখন সেটাই ঘটছে।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অবশ্য সতর্ক করে বলেছেন যে শীতকালীন আবহাওয়াতে ভাইরাসে প্রাণহানি অবশ্যই বাড়বে কারণ এই সময়ে লোকজন ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া এবং হাঁপানির মতো অনেক ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ‘যদি এমন রোগে আক্রান্ত কেউ করোনায় আক্রান্ত হয় তবে তার জীবন বাঁচানো কঠিন হবে। সুতরাং, মৃত্যুর হার বাড়তে পারে।’
তিনি বলেন, সরকারের উচিত জনগণকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মগুলো যেমন মাস্ক পরা, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম এড়ানো এবং যেকোনো সংক্রমিত ব্যক্তির কাছাকাছি আসার পরে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে উত্সাহিত করা।
‘মানুষ যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশিকা মেনে না চলে, তবে তাদের বাধ্য করতে সরকারকে আইন প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকবে,’ ডা. মোজাহের সতর্ক করেন।
এছাড়া তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আগত লোকদের বিমানবন্দর ও বন্দরে স্ক্রিনিং করতে হবে এবং তাদের আইসোলেশনে রাখতে হবে। ‘বিদেশ থেকে আসা ভাইরাস রোধ করার জন্য আমাদের এখনই কঠোরভাবে এটি করা উচিত।’
করোনার প্রথম ঢেউ এখনও আছে
ডা. মোজাহের বলেন, করোনার প্রথম ঢেউ এখনও চলছে বলে দেশ শিগগিরই দ্বিতীয় ঢেউ দেখতে পাবে না। ‘দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, কারণ আমাদের প্রথম ঢেউই এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি।’
ডিজিএইচএসের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নাজির আহমেদ বলেছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করতে ‘সরকারের ব্যর্থতা’র কারণে বাংলাদেশ করোনার সংক্রমণের দীর্ঘ চক্রে প্রবেশ করেছে। ‘আমরা এখনও করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের মধ্যেই আছি।’
তিনি বলেন, ইরান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ব্রাজিলের মতো আরও অনেক দেশ শীতের আগমনে একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে কারণ তারা প্রথম ঢেউই নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।
‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি, আইসোলেশন, পর্যাপ্ত পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইন এবং আইন প্রয়োগ হলো ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার উপায়। তবে আমরা এটি করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি,’ বলেন এই বিশেষজ্ঞ।
তার মতে, সংক্রমণের হারের তুলনায় মৃত্যুর হার খুব কম হওয়ায় এখানকার লোকেরা কিছুটা ভাগ্যবান। ‘তবে শীতকালে অন্যান্য ভাইরাস এবং ফ্লুর কারণে মৃত্যুর হার বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং, ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রচেষ্টা আরও তীব্র করা উচিত।’
হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করুন
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সেনাল বলেছেন, অনেক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে শীতের সাথে করোনার সম্পর্ক রয়েছে এবং শীতকালীন আবহাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
যেহেতু আগামী দিনগুলোতে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়তে পারে সেহেতু তিনি বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের জন্য সরকারের উচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সমস্ত হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা।
‘প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে আইসোলেশন কেন্দ্র রয়েছে, তবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ওষুধ এবং অক্সিজেন সরবরাহ, সেফটি গিয়ার এবং হাই ফ্লো নাসাল ক্যানুলার অভাব রয়েছে। এছাড়া জেলা হাসপাতালে আইসিইউ বেড ও অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করা উচিত,’ বলেন ইকবাল।
তিনি বলেন, লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে অতীতে জাতিকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। ‘একই ভুল পুনরায় যেন না হয় সেজন্য আমি সরকারকে অনুরোধ করছি। স্বাস্থ্যকর্মীদের যেকোনো উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারের উচিত পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা।’